পরানকথা (Bosom’s Word)

Collection of Bengali Short Stories

PKRB

পরানকথা – গল্প সংকলন

পরানকথা সম্পর্কে বলছেন ভিন্নমুখ পত্রিকার সম্পাদক কবি চিত্তরঞ্জন হীরা

পরানকথা পড়তে গিয়ে প্রথমেই একটা ঝাঁকুনি লাগল। তবে গল্পের জন্য বলা গল্পের ঝাঁকুনি নয়। বরং একটা বিপরীত চলা-বলা গল্পহীন গল্পের ঝাঁকুনি। আছে কিন্তু নেই, অনর্গল পাঁচমাত্রায় আত্মার কথা বলে যাওয়া। প্রাণের মধ্যে যে জন আছে তার সঙ্গে প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে দেওয়ার কথা বলে যাওয়া। আহারে কবিতা! ‘সূর্যোদয় আর ফুটনোটে নেই। ছড়িয়ে দেওয়া কিরণমালায় ঢল নেমে আসে, জ্যোৎস্না হয়ে যায়। ‘শোধ’ – এও মিলল প্রাণের স্পর্শ, জীবনবোধের স্পর্শ। পাকদণ্ডির বাঁকে বাঁকে যে অকাল অন্ধকার তাকে মুছে দিতেই একটা ঝর্ণাকলম যেন মাদল বাজিয়ে চলেছে, ধারা থেকে ধ্বনি, থেকে থেকে উশ্রি হয়ে এবিশ্বে এক আলোর ইশারা। ‘পেন্নাম হই গো বাবুমশাইরা’ – নামকরণটা বাদ দিলে পুরোটাই গান হয়ে ওঠা। গানবাগান, গানাকাশ, গানমাটি, গানগোলার্ধ গল্পে নয় মনের মধ্যে আকাশটা, অনেক আগেই ভোকাট্টা। সেই ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল…’ উড়তে উড়তে, উড়ানে উড়ানে, এমন একটা গল্পও তাহলে বলে ফেলা যায়!

‘টিফিনবক্স’ একটা ফ্ল্যাশব্যাক, একটা ঝলক। ঠিকঠাক অণুগল্প। ‘পঞ্চ ম’কার সাধন’ – রসরচনার অনেক রসদ নিয়েই হাজির। তবে ভাষা নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিল। আসল মজাটা যা আছে তার মধ্যেই ডুবতে ডুবতে চুনোপুঁটিগুলো ফাঁক দিয়ে গলে গেল। পড়ে রইল রুইকাতলা আর ইলিশ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাবু’ বৃত্তান্তের দশাবতারের কথা মনে পড়ছিল।

‘মানুষ এখনও মানুষ’ – আছে বলেই মানুষের খবর হয়। মানুষের জন্য জমানো কান্নাগুলো এখনও অক্ষর পায়। মানুষের জানলাগুলো যখন একটা একটা করে বন্ধ হয়ে আসে তখনও দেখা যায় দূরের কোথাও কোনও জানলার ফাঁক তখনও আলো দিচ্ছে, আলো নিচ্ছে। কিন্তু ভুল মানুষের অপচেষ্টায় কতকত মরমীগ্রামের সত্য যে চাপা পড়ে যায় মরমের তলে, তাকে আর আলোয় ফেরানো যায় না। ভুল মানুষের ইতিহাস কোথাও কোথাও বড় হয়ে ওঠে। কত সত্য যে আর আলোয় ফিরছে না, সে কথা কে বলবে কাকে! হ্যাঁ, ‘সবাই হাঁটছে মানুষের জন্যে’। কিন্তু ‘কতটা পথ পেরোলে তবে মানুষ বলা যায়?’ রাজনীতি কোনও কল্পনীতি নয়, এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র ও অমানবিক। নীতি বা আদর্শের ভিত যত নড়বড়ে হবে তত আমরা ভুল মানুষের পায়ের ছাপ দেখতে পাব। বিভ্রান্ত হবে সৃষ্টিলোকও।

যাহোক, ‘রবিবার’, মীনপরী গল্পদুটোও কবিতার মত। উদাসীন ভাববাক্সে জমা হচ্ছে। টোল পড়ে ছায়ার নরম গালে। আর আমরা টলে টলে পড়ি, চোখের বাসায় আলো বসাই। ‘পাত্রী চাই’ – গল্পটিও রম্য হয়ে উঠেছে উপস্থাপনার গুণে। ভাষার ক্ষেত্রে সেই অসচেতনতা। একটু বিস্তৃত এবং ছড়িয়ে পড়া। সে অর্থে ‘কর্ণকুন্তীকথা’ এ গ্রন্থের সেরা পাঠ আমার। চলনে বলনে উঁচুমাত্রায় বাঁধা। হাওয়ার টানে কথারা ভাসছে না, কথার টানে গল্প ভাসছে। আড়ালরহস্য, আলোআঁধারি সব রয়েছে। ঠিক তারপরই ‘বনসাই’, গরাদের পরোয়ানা ছিঁড়ে হৃদয় উড়ছে। আদর খাচ্ছে হাওয়ার পালনে। কন্যাভ্রূণ হত্যার প্রতিবাদ, পুরুষতন্ত্র এবং লেখকসত্তার মাঝখানে সত্তাহীন মানবের প্রগতিশীলতা – সব ধরা রইল শদুয়েক অক্ষরের মধ্যে। নদীটা প্রবাহিত হচ্ছে…।

‘যদি তারে না-ই চিনি’ – জীবনের সত্যগুলো উপলব্ধি করতে বসলে মনে হয় আমাদের মন যতটা অবাধ তাকে সেভাবে উড়তে দিলে চারপাশে আরও আরও কত অনর্থ, সমাজশৃঙ্খলাহীন এক বেপরোয়া। আবার সেই কতটা পথ পেরোলে…। ‘ঠিক দুপুরের জানলাটা’ – সময়ের চিহ্ন, বিষাদ, স্মৃতিমেদুরতা। ভীষণ রোমান্টিক। ভেতরে গান বাজছে। যদিও প্রতিটা গল্পের মধ্যে গানের আবহ আমি টের পেয়েছি। ‘ভাঙা-গড়া’ গল্পটাও আমাকে টেনেছে। উপলব্ধিময় বিশ্বে গানের সত্যতা এবং জীবনের প্রবাহ যাকে দার্শনিক করে তোলে তার তল খুঁজতে গেলে সমান অনুভবী হওয়া প্রয়োজন বলেই মনে হয়। ‘এসো বয়কট করি’ – কিন্তু কাকে? জীবনের তরঙ্গ খুব ক্ষণস্থায়ী জেনেও আমরা জীবনেই ফিরব। আমরা কবিতায় ঘুরেফিরে পরানকথা বলব। (দুটি পরানকথা কেন? পরানকথা-এক, পরানকথা-দুই হতে পারত)।

আবারও বলি গল্পগুলোর মধ্যে উপলব্ধির জায়গাটা খুব বড়। চরিত্রগুলো কখনই আত্মধ্বংসী হয়ে ওঠেনি। বরং বাস্তবকে ছুঁয়ে থাকার ইচ্ছেডানা উড়ান দিয়েছে সর্বত্র। শেষ পরানকথাও নিস্তব্ধতার সুতো বেয়ে বেয়ে গভীরে টানতে থাকে, বা নামিয়ে দিতে চায়। মউসন্ধানী মনের কোণে একটা সুন্দর বন গড়ে তোলে।