নিলামবালা ছ আনা – কবিতা সংকলন
- Nilambala Chha Anna : A Collection of Bengali Poems
- Release Date : January 2013
- Publisher : Ekhon Bangla Kobitar Kagoj, Jalpaiguri, WB, India
- Pages : 64
- Price : Rs. 50
নিলামবালা ছ আনা সম্পর্কে বলছেন – নতুন কবিতার সম্পাদক কবি স্বপন রায়
‘নিলামবালা ছ আনা”’ কবিয়ত্রি রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।বইটির প্রকাশক ‘ “এখন বাংলা কবিতার কাগজ”’।রুণার কবিতায় সম্ভাবনা এবং অস্তিত্ব এক বিজড়নের দ্বন্দে জড়িয়ে যায়। সাধারণভাবে কবিয়ত্রিদের সাধারণ প্রবনতা থাকে “নারী”এই শব্দের অনিশ্চিত প্রবাহে মিশে যাওয়ার।পুরুষতন্ত্রের মূল্যবোধগুলিকে আক্রান্ত হতে দেখি তাঁদের কবিতায়,দ্রোহের স্বখাত-ঘেঁষা সলিল উদ্ধার করার প্রয়াসেও মেতে ওঠেন কেউ কেউ। আবার কয়েকজন “নারী” শব্দের জন্মযন্ত্রণাকে অতিক্রম করে কবিতাকে সময়জেতা কালানুশাসনের বাইরে নিয়ে যেতে চান,কবিয়ত্রি রুণা এই গোত্রের কবি।তিনি লিখেছেনঃ
“….আকাশখোঁজা তালিকাটি ছিলো এইরকমঃ
১. চোখের বর্ণমালা ছুঁড়ে দিলে মৌবনীর কানের লতিতে একটা পাখি ডেকে উঠবে
২. টই টই ঠোঁটে প্রজাপতি উড়ে গেলে আলোহরকরা নামবে বৃন্তের অবকাশে
৩. গ্রীবার গহীনে জলছাপ বৃষ্টি নামালে থরে থরে ব্রহ্মকমল ফুটে উঠবে নাভিকেন্দ্রে
(অসম সমের দ্বিমাত্রা/পৃঃ১৩)
বাংলা কবিতার ভাষা নব্বইয়ের শুরু থেকে পাল্টাতে শুরু করে। “নতুন কবিতা”র প্রভাবে সুররিয়াল কবিতার কেন্দ্রাভিমুখি স্বয়ংক্রিয় চেতনার গতিপথটি উল্টে যাওয়াতে কবিতার ভাষা এবং বিন্যাসের পরিবর্তন হতে থাকে নানাভাবে।কবিতার একরৈখিক সিদ্ধান্তমূলক বা সিদ্ধান্তহীন স্বয়ংক্রিয় উচ্ছাস ধীরে ধীরে তরুণ প্রজন্মের কবিতা থেকে চলে যেতে থাকে।প্রথাগত ছন্দের একঘেয়ে উচ্চারণকে “গান” লেখার কাজে লাগিয়ে দিয়ে কবিরা বেরিয়ে এলেন একাডেমিক খাঁচার বাইরে,স্বভাবতই কবিতার এই নতুন খোঁজ তারুণ্যের চঞ্চলতায় বিচিত্র হয়ে উঠলো!কবি রুণার উদ্ধৃত অংশটি পড়লেই অনুভূত হয় এ এক অনুসন্ধানি মনের লিপিমাত্র যা কবিতাকে সংযুক্ত করেছে,নিরাবরণ করেছে।আরো কিছু লেখা পড়া যাক :
১”..চুমু থেকে দু এক পা হেঁটে এসে এসে দেখো/ঠোঁটের আভাস/মৃদু হতে চায়
(দেয়াল বসাচ্ছে বিনয়ী আকাল/পৃঃ৪১)
২।“সোনাজলে বাঁধাই হচ্ছে তুমিলীন পট/নিখোঁজ জিয়নকাঠি”
(হাতল ভাঙা কেদারার ধুন/পৃঃ৫৩)
৩.”ফলত/হাড়ের ভেতর ঘাসলতানো সম্পর্ক/ একা বসে বেহালা বাজায়/দ্বীপান্তরের ড্রইংরুমে”
(তেকোনা এপিসোড/পৃঃ৩০)
কবিয়ত্রি রুণা কোন সৈদ্ধান্তিক কবিতার পরিমন্ডল গড়ে তোলেন নি! তাঁর পক্ষে যুক্তির পথে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো স্বাভাবিক ছিলো! তিনি স্বনামধন্যা বিজ্ঞানী,কিন্তু বেছে নিয়েছেন যুক্তির নিগড় ভাঙা কবিতার পথ,তাঁর কবিতায় বিজ্ঞানের গ্রহণ যেমন রয়েছে,অন্যদিকে কবিতার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক যুক্তির বিরোধাভাসটিকে মিথষ্ক্রিয় করে তোলার অবিশ্বাস্য প্রয়াসটিও রয়েছে।মহাকাশ বিজ্ঞান ,অতিচেতনা,কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর স্ত্রীয়ত্ত্ব রুণার কবিতাভাষাকে করে তুলেছে বিশিষ্ট,এমনই তার দক্ষ প্রয়োগ যে যা এক জটিল সন্দর্ভ হতে পারতো হয়ে উঠেছে এক অনায়াস কবিতা:
Read More কবি স্বপন রায়, সম্পাদক নতুন কবিতা
নিলামবালা ছ আনা সম্পর্কে বলছেন : কবি পার্থপ্রতীম রায়
২০১৩ বইমেলায় অতনুদা আমাকে রুণাদির বইখানি হাতে দিয়ে বলেছিলো বইটা পড়ে রুণাদিকে ফোন করিস। সৌভাগ্যবশত বইটা নিয়ে অল্পকিছু লেখার সুযোগ পেলাম, আমার মতো করে। ইঙ্গিতময়তার পরিচিত বিন্যাস থেকে অনুভূতিকে বিস্তার করে শব্দের মিথকে উপস্থাপনা করেছেন যা নির্মাণশৈলী ও শব্দচয়নের এক অন্যতম নিদর্শন। অর্থের ডোর ধরে রেখে সমান্তরাল ভঙ্গিমায় ব্যক্ত হয়েছে। রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “নিলামবালা ছ আনা” বইয়ে শব্দ প্রয়োগের সচেতন ভাব প্রদর্শিত… শুরুতেই ‘গলন থেকে খুলে রাখা অঙ্কগুলো’ কবিতাটি অসম্ভব ইমাজিনেশনের কবিতা। কবিতার মাত্রাবোধ এতো সুচারু ও বাদশাহী হতে পারে এর আগে দেখিনি। বৃত্তের চারুলতা থেকে শুরু করে প্রমিতক্ষরণ বিন্দু সবই মুগ্ধতার সামনে দাঁড় করায় — ‘অঙ্ক থেকে অলঙ্কারে চন্দ্রছোবল চারুকলা’
অন্যদিকে, মনের অন্তঃপুরে পৌঁছে যাওয়া ভাবনার উষ্ণতায় মজে যাওয়া খেয়াল যেটা রাখুন- ‘ক্রিয়া সম – প্রতি দুটুকরো দুটো অসমতার ভেতর যেন বাতাস বুনে দেয়
ক্রিয়া অসম – প্রতিটি অসমতায় পাখির ডাক
ক্রিয়া হীন – প্রতিটি ডাকে একটু ডাকহরকরা আকাশ’
এমন তিনটি লাইন! ‘দাবা থেকে দোয়াবঘেরা ছকে’ কবিতাটিকে ভাষ্য করে তুলেছে। মনের জ্যামিতিটুকু ফাঁকা ক্যানভাসে সাজিয়ে বিনির্মাণ।
‘স্কয়ারের সমান্তরাল বাহুর অসহ্য সমতাগুলো দুটুকরো করি’
এরপর কি বলা যেতে পারে …!
খণ্ডচিত্রে ভরপুর ‘আজ কোনো বৃষ্টির সম্ভবনা নেই’ কবিতায় শব্দ প্রয়োগ এবং ব্যঞ্জনা অসামান্য ব্যবহার লক্ষিত হয় —
‘এক চুমুক নীতির সঙ্গে
দু একটা হালকা হরিণী কানুন
জাহাজডুবির সম্ভাবনারা বন্দর ছাড়িয়ে বহুদূর’
কবিতায় অনুদৃশ্য আর অদ্ভুতভাবে একটা শব্দই দৃশ্য হয়ে গেছে। রুণাদির বইয়ের কবিতাগুলো মন দিয়ে পরেছি,ভুলে গেছি, আবার পরেছি এবং আরো ১০টার সাথে কোন পার্থক্য পায় না। কি অদ্ভুত তাই না? একজন সাধারন পাঠক হিসাবে বলতে পারি, একটা কবিতা পড়ে কতটা মনের তৃপ্তি হতে পারে। এই তৃপ্তি যেমন একটা কবিতা পড়ে হতে পারে তেমন আবার কবিতার মধ্যে থাকা একটা লাইন পড়েও… ‘ইসফিসকুলের এলিজি’ কবিতাটাও ঠিক তেমনি, এই কবিতায় শব্দ বুনন পদ্ধতিতে রয়েছে কম্পন উত্তেজনা_ ‘স্তিমিত মাত্রাবোধ খুঁজছে ফুলস্টপ/ স্থিতি নামছে বর্ণমালিত মগজে’
উজ্জ্বল কল্পশক্তি… ‘হাতলভাঙা কেদারার ধুন’ কবিতায় কখনো কখনো ফ্লোলেস মনে হলেও লেখনির অব্যক্ত স্পীড আমাকে আকৃষ্ট করেছে। ছোটো ছোটো যাপনের পরিসরকে একত্র করে লেখা যেখানে সিম্বলিক ভাবকে ক্ষুণ্ণ করে না…
এছাড়াও ‘কামায়ন’ ‘বেহায়া’ ‘চাঁদ কৌণিকতা’ ‘তেকোনা এপিসোড’ কবিতাগুলি ভাল লেগেছে।
ক্রমশ বদলে যাওয়া আঙ্গিকে বাংলা কবিতার সময়ে রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইখানি অন্যতম বলা যেতে পারে,শব্দের অনুভব ও বিচিত্রতা মানুষকে এমনই একীভূত করে দিতে পারে…
Read Moreপার্থপ্রতীম রায় জার্নি৯০
নিলামবালা ছ আনা সম্পর্কে বলছেন : কবি প্রণব পাল
“দিগন্তপ্রচারে নেমে এল
সমান্তরাল আয়নারা
পারদের স্তর নিয়ে অগ্রিম হুল্লোড়
নেচারের দূরবীনস্ত চোখে
দাঁড়িকমাহীন আশালতার পাঠশালা
ভ্রূণ ফুটছে স্কিট্জোফ্রিনিকের
তালকানা শব্দকোষে” (পরানমণ্ডল ভারসাস কেপলারমণ্ডল/পৃ:৩৬)
নতুন কবিতার আবহেই নিজেকে খুঁজে পান রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। নতুনের গন্ধ তাকে পাগল করে ছোটায়, সঙ্গে মহাকাশ বিজ্ঞানের মস্তিষ্ক ও চেতনা। দ্রুত সবকিছুকে আত্মস্থ করার ক্ষমতা আর গদ্যে পদ্যে আলোচনায় নতুনের গভীর অনুসন্ধানের নজর আর অফুরন্ত প্রকাশের তাগিদ তাঁকে পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশের দিকে নিয়ে গেছে। সবকিছু আহরণ করার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে একটা নিজস্ব রুণা। বিষয় ভাবনা থেকে মুক্ত। বহুমুখে ছোটার তীব্রতা এবং ভিন্ন ব্যবহারের ঝোঁক সঙ্গে ধ্বনি চেতনার উন্মেষ লেগে আছে রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায়। বোঝা যায় একজন কবি আহরণ করছেন নানা দিক থেকে। গ্রহণ করছেন পরক্ষণেই তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন পরবর্তী লেখায়। মুগ্ধতা ওঁর স্বভাবজাত। ফলত যে নতুনেই তিনি মুগ্ধ হন সেখানে বিচরণ করেন আয়ত্ত করেন তাকে, তারপর আবার শুরু হয় তার মানসযা্ত্রা যে যাত্রায় কোনো সীমাবদ্ধতা নেই – আছে ভালোপাহাড় থেকে মহাকাশপুরের ছুট ও ছুটের হদিস। এক নতুন সন্ধানী কাব্যিক বাউলতা।
সম্পূর্ণ পাঠ কুরুক্ষেত্র পত্রিকা ৩, বৈশাখ গদ্য ও কবিতা সংখ্যা