তামস জার্নাল (Journal of Dark)

তামস জার্নাল – কবিতা সংকলন

final tamas journal

Tamas Journal : Collection of Poems in Bengali

  • Publisher – Kaurab
  • Hardcover
  • ISBN-10: 9381856109
  • ISBN-13: 978-9381856109
  • Released Date – January 2014
  • Pages – 71
  • Price – Rs. 50

Amazon এ তামস জার্নাল

তামস জার্নাল  সম্পর্কে বলছেন : নতুন কবিতার সম্পাদক কবি স্বপন রায়

তমসাভেদী আধারে 

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “তামস জার্নাল” আমায় কবিতার লগ্নীকৃত আবহাওয়া থেকে বিলগ্নীকরণের দ্বন্দ্বপ্রাখর্যে নিয়ে এলো! এ সেই কবিতাঘন অনাস্থা যা আমায় আরো একবার মনে করিয়ে দিলো কবিতা আমার মধ্যে নেই, মননগত হয়ে নেই কবিতার তথাকথিত অস্মিতা, কবিতা সেই অনাস্বাদিত চারণভূমি যেখানে কবি কবিতার সঙ্কেত খুঁজে পায়, চমকে ওঠে,আহ্লাদিত হয়! রুণার এই বইটি তার নিজের পূর্বে প্রকাশিত বইদুটি থেকে অন্যমাত্রার! এই বইটিতে সরন্তদ্যুতির সঙ্কর রসায়ন অবিরত চলতেই থাকে, সেখানে কবিতার চালু মাপকাঠিগুলো পানসে হয়ে যায়, হারিয়ে গিয়ে ভেসে ওঠে আদৃত মূল্যবোধের অসম্বৃত সূচিমুখগুলো :

“একা হাওয়া
একলা আকাশ
একপশলা প্যাশন
অলখ স্বরে ডেকে নেয় কমলা রঙের বেলুনগুলো…”   (ম্যাজিক শহর//পৃ:১৬)

লিখেই রুণা এক স্বয়ংপ্রভ টেক্সটের অভাবিত নিয়ে আসে, ভেঙে দেয় কবিতার সিঁড়িকামোহ, সরাসরি গদ্যের কাঠিণ্যে নিয়োগ করে নিজের প্রতিসরিত দেখাশানাগুলোর তমসাদীর্ণ আলোকরেখাগুলি, মনে হয় কবিতার সাজানো বিভ্রমে এসে গেছে কণাবিজড়িত সেই অভিঘাতসমূহ যা এক এস্পার ওস্পারে দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠককে!

আর এখানেই শুরু হয় যা রুণা লিখেছে, ‘চলো,দেয়াল ভাঙি/গড়ার আগে’! ভাঙা যখন সুপ্রযোজিত হয় এবং নিয়ন্ত্রিত, তখন “গ্রহ নক্ষত্র ফেরে না আর/চাঁদ বিছানো প্রেমাবোল তাবোল ফোটায়/লালবাতির অবৈধ হরফে…” পাঠক, অসহায় পাঠক তো “সংশয়ে টলটলানো নিউক্লিয়াস…” সে দেখে রুণা কিভাবে বন্ধনের অনুগামী সমস্ত এককগুলো ভেঙে দু টুকরো করছে আর কবিতা তার সুখি গৃহকোণ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এক মুহূর্তের এক সম্ভাবনার দিকে….আমিও তো পাঠকই, আমি এমন বিগঠিত চলনে কত ভাবেই না আরোপিত করি নিজেকে!  রুণা দেখিয়ে দেয়, “হাড়ের ভেতরে লাফিয়ে উঠছে ছায়া”, দেখায় আমার “বুননগ্রস্ত আঙুল” আর আমার  “হারমোনিকাপ্রবণ ঠোঁট”….রুণার “ম্যাজিক শহর” কখন যেন আমার হয়ে ওঠে!

এবং আমি দার্শনিক হতে পারিনা আবার! ঔকাদ দেখিয়ে দেয় রুণা : “দরজার নিহত হলে যাওয়ারা স্বপ্ন দেখে/স্মৃতিজটে ঝুলে থাকে/ফেরার নির্দেশ (পৃঃ১১/দার্শনিক), কবি চাইলেও সত্যের চরমে আস্থা রাখতে পারেনা, রুণাও তাই তার পাঠককে ব্যতিক্রমী অস্থিরতায় নিয়ে যায়, তার কবিতা পাঠকের কাছে নিয়ে আসে হাজার দরজার বিকল্প, কবিতা’র ব্যক্তিগত সীমানা ছড়িয়ে পড়ে পাঠকের সংশয়াচ্ছন্ন পাঠসূত্রগুলিতে, কবিতায় চমক থাকেনা আর, সেভাবে পালিশও থাকেনা, শুধু এক অনিবার্য অসমাপাতনে রুণা বিস্মিত করে চলে:

১. ভরের  কথা অনেক হল
   গতির কথাও
   হয়তো বা ভরগতির অসমান প্রতিরোধেই তোমার মার্জিত জাগরণ অথবা একান্ত  ঘুমঘোর                                                                                                                             (অনন্তের প্রশ্নচিহ্ণগুলো/পৃ:৭০)

২. ভাবনার খোলা পিঠে আভূমি নদীর ঝোঁক
  গাঢ় ঘুম
  মৃদু স্বপ্ন
  শুধু জড়তার পাশে জেগে থাকে আমার ঘুমের সমস্যা
                                   (আলম্ব/পৃ:৬৬)
 ৩.
স্নায়ুকোষে খুব সতর্ক এক সাপ
দুলছে
এপাশ
ওপাশ
বিষন্ন তার নাম খুঁজছিল              (চিহ্নকের অদৃশ্য ছুরি//পৃ:৬১)

অদ্ভুত না? রুণার কবিতা যেন উত্তরের অপেক্ষায় না থাকা প্রশ্নের স্বাধিকারপ্রমত্ত বিকিরণ, ওই “একটু ডিও নাকি ধুনো” ধরণের, যেমন রুণা লিখেছে! আর মনে করিয়ে দিয়েছে হাল্কাভাবেই “আনসারটেনিটি প্রিন্সিপলের” কথাও! রুণা ধারণাকে ভাবনার বিভঙ্গে রাখে, তার সুপ্তি ভেঙে দেয়, আর জাগিয়ে দিয়ে দেখাতে চায় এক ছকহীন দুনিয়ার কেওটিক তরঙ্গনৃত্য যেখানে কি এক অসম্ভবের ছোঁয়ায় এমন নাদৃশ্য হতে থাকে :

“তোলপাড় রোল
            বোল
               ও বোলানো ধারাবাহিক
খুলে খুলে যায়
শ্রীমতীর বাজুবন্ধ…”                 (অস্বীকার/পৃ:৪৪)

রুণার এই তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক, “কৌরব”! পাঠক আপনাকে এই “বেরংনামা” পড়তেই হবে,
নইলে “রুমাল থেকে নোস্টেট বেড়ালে” পৌঁছবেন কি করে?           

বাক পত্রিকায় বিস্তারিত

 

তামস জার্নাল সম্পর্কে বলছেন : ভিন্নমুখ পত্রিকার সম্পাদক ধীমান চক্রবর্তী

তামস তামস!
আমাদের যাপন কোন খোঁজের দিকে ঠেলে দেবে তা পূর্বস্থির নয়। স্তব্ধতা ও তমিস্রার দিকে যাত্রা, ভিন্ন ভিন্ন রূপে দরজা খুলে দেয় ভ্রমণকারীর সামনে। দরজা সবার না থাকলেও অপেক্ষা থেকেই যায়। সেখান থেকে ফেরা না ফেরা,  ক্তিমানুষের ওপর নির্ভরশীল। দরজারা নিহত হলে কোথাও হয়ত থেকে যায় পরবর্তী নির্দেশ। এই জার্নি তো জীবনেরই, কুরুশকাঁটায় স্মৃতি বুনতে বুনতে আপাত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকা। শর্তহীন জীবনে একে একে জমা হতে থাকে যাওয়ার স্বপ্ন। হয়তো ‘স্মৃতিজটে ঝুলে থাকে ফেরার নির্দেশ’। এই যাতায়াতে সংখ্যাহীনভাবে জুড়ে যায় কত রূপকথা কত বাক্যবিনিময়ের সুতো। সেখানে হয়তো কেউ কাচের পোষাক পরে হেঁটে যায়, কেউবা একমুঠো বৃষ্টি নিয়ে। যদি সেই জার্নি কবি রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয় তবে,

“আমি লাটিম থেকে বাক্যবিনিময়ের সুতো খুলে খুলে ঘুরে যাই
অনির্দিষ্ট বিষয়ের বৃত্তে”                         (এমন আঙুলে কি আগুন সম্ভব/পৃ:৯)

তাহলে কি সেই বিষয়ের বৃত্তের অন্ধকার থেকেও নেই, কেননা বইটির নাম ‘তামস জার্নাল’? বোধহয় তিনি দেখতে পান সেই অন্ধকারের মধ্যে জেগে থাকা আলো এবং আগুনকে। খোঁজ পাওয়া যায় এক সচল অন্ধকারের। তখন আলোকে বলতে হয়, সে যেন সারাদিন দরজা না থাক্কায়। ওই দরজার কখনো এপাশে বা ওপাশে দৌড়ে যায় আলোর আঙুল। আগুনসম্ভব আঙুল। এরপরই তো নিস্তব্ধতা আর অন্ধকার। জানলার বাইরে থেকে যায় লুটিয়ে পড়া পায়রা। সেখানে তো শুধু যাওয়া নেই, থাকে যাতায়াত। থেকে যায় জীবনের কিছু কিছু চিহ্ন, শুশ্রূষা, বিদ্যুৎপ্রভা ও শঙ্খধ্বনি। শরীর খুলে তারা বিভিন্ন রং খায়, পরিষ্কার করে আহ্লাদিত কবুতরটির বার্নিস করা দুটো চোখ, প্রতিবিম্ব। এলোমেলো পায়ে বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে মেরিজান মেরিজান বলে ওঠে –

“ঘুমহীন চোখে শুশ্রূষার শিস্‌
একটা
একটা
করে তুলে নেয় বিঁধে থাকা তির
উজ্জ্বল বিদ্যুৎপ্রভায় গলে যায় তিরচিহ্ন
রাত্রির নৈঃশব্দ্য ঘিরে বেজে ওঠে
নিমগ্ন সঙ্গমের প্রিয় শঙ্খধ্বনি”
                    (রাতচিহ্ন/পৃ:৩৮)

জীবন যতটা চায় যাপনও কি ততটা চায়, উঠে আসে জড়িয়ে থাকে এই প্রশ্ন অস্তিত্বের প্রতিটি দর্শনে। তখনই তো হিসেবের প্রাত্যহিকতায় একটার পর একটা শূন্য বসতে থাকে। সীমা ছাড়িয়ে সে অসীম হয়। সম্পূর্ণ ভেঙে অসম্পূর্ণ। জন্মানোর প্রথম দিন থেকেই আমরা একটু একটু করে ছোট হচ্ছি সীমা হয়ে উঠছি, আর শূন্যের পেখম দুলে দুলে উঠছে সপ্তলোকে। এসময় মোমবাতি অসম্পূর্ণ প্রপাতে, শূন্যের জলছাপমাখা সুড়ঙ্গে। এই স্নানযাত্রায় অসম্পূর্ণ কিংবা শূন্যের অন্তত একটি দরজা থাকে বা থাকার সম্ভাবনা। এই তো জীবন একটু আগে শুরু হল। হয়তো এসময়ে কোমর ও বিছেহারে লেগে থাকে অনেকটা বসন্ত। ওখানেই থাকে শূন্যের যোগফলে গড়ে ওঠা মানুষের অসম্পূর্ণ দ্বিতীয় পৃথিবী। সেখানে পৌঁছোনোর জন্য রুণা অনুভব করেন –

“দরজা সকলের থাকে না
যদি একান্তই প্রয়োজন
কিছু দাগ রেখে যেও
নৈঃশব্দ্যের
বিস্মরণের”                  (দ-র-জা/পৃ:৩১)

যাওয়া আসার খেলায় মেতে আছে যাপন। সেখানে দরজা থাকলো কি থাকলো না, কি এসে যায়। মহাশূন্য যখন ছিল না, তখনও এই যাপন নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও ছিল। জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, যা নামলো তা গাছের পাতা না শূন্যের যোগফলে গড়ে ওঠা মানুষের অসম্পূর্ণ জীবন। ওই অসম্পূর্ণ জীবনের কোন একপাশে থেকে যায় আলোর বলেদের আস্তে ধীরে গড়িয়ে যাওয়া। যাতায়াতে বিশ্বাসী জীবন একদিক থেকে অন্যদিকে গেলে, আলোর পক্ষ পরিবর্তন করে। অন্ধকার আর গহ্বর নিয়ে খোসগল্প করে। দেখি অন্ধকার আর না-অন্ধকারের মধ্যে ঝুলে থাকা আত্মবিশ্বাস, জন্মদিনের কেক কাটছে। তাহলে ওই অন্ধকারেরও একটা জন্মদিন ছিল। ছিল কি? ছায়া ও আঁধারে ঝুলে থাকা অন্তর্বর্তী বারান্দা থেকে এই খোঁজ এক নির্জন কারুকাজ।

“আমি তো সীমানা দেখেছি
তামসের গায়ে জেগে থাকা গহ্বর
আরো এক অন্ধকারের গল্প বলে
গল্পেরা যেখানে শেষ হয়
সেখান থেকে শুরু করে আলো
অন্য জীবন সে
অন্য কাহিনী”              (রুমাল থেকে নোস্টেট বেড়াল/পৃ:৩৯)

এই তবে দিক পরিবর্তন। অন্ধকার থেকে হয়তো আলোয় আসা। তবুও অন্ধকার ত থেকেই গেলো তার নিজস্ব আলো নিয়ে। ওই আলোতে ওই অন্ধকারে থাকে মানুষের সম্পর্কগুলো, থাকে একটা ইকোসিস্টেম। যেখানে হাতড়ে হাতড়ে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে হয়। সেই অবস্থান হয়তো গোল বা বর্গক্ষেত্র। আলো যখন স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ওঠে, সস্নেহে পিঠে হাত রাখে অন্ধকার। টলটলে জলতল নেড়েচেড়ে জীবন খুঁজতে চাওয়া। যেখানে অন্ধকার আর আলো পরস্পরের কাঁধ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যাওয়া বা আসার কোনো প্রভেদ থাকে না।

“আমি ব্যাপক হয়ে উঠি বিভা ও প্রভার চলে যাওয়া নিয়ে
কারণ চলে যাওয়ারাই একদিন
নিপুণ ফিরে আসার সিগন্যাল হয়ে ওঠে
অথচ যাওয়া আর ফেরা খুব অন্তর নয়”        (ছুরির ধার ও ধারণা/পৃ:৪৯)

এ যেন আবহমান ও ধারাবাহিক চলনকে চিহ্নিত করা। একজন কবি শব্দের সেলিব্রেশানে নিজেকে খুঁজে পান। তিনি শব্দের বুকের ভেতর জীবন বা জলের নামতা বুনে দেন। শব্দ সেসময় ‘শূন্য অর্থবোধ’-এর দিকে যাত্রা শুরু করে। “আমি অর্থের কথা ভাবিনি তেমন/হারিয়ে যাওয়ার কথা/ভেজা রাস্তার কথা/এসব অপরিহার্য নয়”  (চিহ্নকের অদৃশ্য ছুরি/পৃ:৬১)। অপরিহার্য নয় বলেই কোনো শেষে আমরা পৌঁছতে পারিনা শেষপর্যন্ত। কেননা –

“প্রকাশ উড়ছে
অথচ ওড়া ও নাওড়া এক অকথিত ভঙিমা মাত্র”    (সর্পগন্ধা/পৃ:৬৫)

শব্দের গুণ একপাশে সরিয়ে রেখে কবিতাগুলি যাত্রা করে বাঁক নেয় নির্গুণের দিকে। জীবনের মধ্যে থেকেও কোথাও তা ক্রমশ চলে যায় আলো-অন্ধকারের দিকে। খুঁজে বেড়ায় চিন্তা ও চেতনার গতিরেখাগুলো। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার মনোভূমি থেকে বেরিয়ে এসে শুরু হয় তাঁর অনন্তের দিকে ফিরে তাকানো। যার কোন শেষ বা শুরু নেই।

“আমি অনর্গল প্রশ্নচিহ্ন সাজিয়ে রাখি
তার সামনে
তার পিছনে
অবস্থান নিয়ে এত সংশয়
যেন এই মাত্র অনন্ত ফিরে তাকাবে
আমার শুরু না হওয়া
শেষ না হওয়া
ধারার দিকে”                    (অনন্তের প্রশ্নচিহ্নগুলোপৃ:৬৫)

সম্পূর্ণ পাঠ ভিন্নমুখ পত্রিকা,  ১৭ বর্ষ,   ৮২ সংখ্যা,   আশ্বিন  ১৪২৩

Back To Home