তামসের আলোকভ্রমণ (Light Travel of Dark)

তামসের আলোকভ্রমণ : গদ্য সংকলন

tamosh final

তামসের আলোকভ্রমণ  সম্পর্কে বলছেন : ভিন্নমুখ পত্রিকার সম্পাদক কবি ধীমান চক্রবর্তী 

আবিষ্কার ও কবি পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন, ঐ দেখো। কবি দেখছেন পথে যা কিছু আছে। কবির মন দেখছে, মাথায় টুকে নিচ্ছে। কবিতা কখনো শেষ হওয়ার নয়, তা সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। কবিতার একমাত্র অবলম্বন ভাষা,যার সাহায্যে কবি তাঁর অনুভবগুলি প্রকাশ্যে আনেন। আগে মনে করা হত এই ভাষা মানুষ শেখে বাইরে থেকে। যতদিন না নোয়াম চমস্কি এই আচরণবাদী বিশ্বাসকে খণ্ডিত করলেন। তিনি বলেন, শিশুরা এমন বাক্য তৈরি করতে পারে বুঝতে পারে যা কেউ তাকে আগে শেখায়নি বা সে মুখস্ত করেনি। সেভাবে বহু কবিই তাঁর কবিতায় যে খেলা চালিয়ে যান, তা একান্ত তাঁরই তৈরি।

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বইটিতে যা উপস্থাপিত করেছেন, তা একান্ত তাঁর নিজস্ব খেলা। বাংলা কবিতায় পূর্বে এ ধরণের কোনও কাজ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অন্য কোনো ভাষায়ও হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। অন্তত আমি জানি না। তিনি একটি কবিতার বই পড়ে তাঁর পাঠপ্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ তাকে অবিনির্মাণ করে নিজের মধ্যে জারিত করে সেই কবিতাকে পুনরায় নির্মাণ করেছেন। যা হয়ে উঠেছে একান্ত নিজস্ব নির্মাণ। মন তাকে এই স্বাধীনতা দিয়েছে। মনের মধ্যেই আছে সেই ছাঁচ যা তাঁকে প্রতিক্রিয়ার অপর পিঠে অসীম বাক্য তৈরির স্বাতন্ত্র্য প্রদান করেছে। এই সক্ষমতা ও পারদর্শিতাকে বলা হয়ে থাকে অভ্যন্তরীণ ভাষা বা Internalized Language। মানুষের মনের মধ্যে আছে অফুরন্ত ধাঁচা বা আদল, সেখানে ক্রমাগত জড়ো হতে থাকে চারপাশের নির্দিষ্ট শব্দ এবং ধ্বনি – একই সাথে যা অবারিত। ছাঁচে জড়ো হওয়ার পর সেখান থেকে সৃষ্টি হয় অসীম বাক্য। যা একজন কবিকে প্রদান করে চলার পথের যাবতীয় উপাদান।

অনুভূতিদেশ থেকে যে স্ফুরণ হয়, কবি তা পরিবেশন করেন তাঁর কবিতায়। কখনও তা পরিমার্জনের পর সামনে আসে। আর কখনোবা তা হয় অবাধ। বইয়ের এই লেখাগুলিতে দেখি যাবতীয় টেক্সট সাজানো হয়েছে কবিতা এবং গদ্য ভঙ্গিতে। এ সবই মূল বইয়ের কবিতা পড়ার পর সেইসব কবিতাগুলি বা সমগ্র বইটি তাঁকে যেভাবে প্ররোচিত করেছে ট্রিগার করেছে তার ফসলগুলি উনি তুলে এনেছেন। এই জার্নিতে প্রশ্রয় পেয়েছে মন ও অনুভব। যেখানে তিনি প্রাথমিকভাবে আত্মীকরণ করেছেন মূল কবিতাগুলি। তারপর তা ভেতরে ভেতরে অবিনির্মিত হয়ে ফিরে এসেছে নির্মাণে। এই যাত্রাপথে একটি বিশিষ্ট স্থান গ্রহণ করে আছে ডিসকোর্স। এই কথন বা বাতচিত প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছিল মূল কবির সঙ্গে রুণার। সেখানে ছিল শব্দ বা ধ্বনিপুঞ্জের সাহায্যে নির্মিত অবারিত শব্দের উপাদান, যা পরে বাক্যের স্বরূপে বিধৃত হয়েছে। কথপোকথনের সঙ্গে সঙ্গেই মনে জন্ম নিতে থাকে Counter-discourse এবং অবিনির্মাণ। মনের গতি প্রকৃতি অবাধ। সে দিশা থেকে বিদিশায় চলে যেতে পারে চোখের পলক ফেলার আগেই। এই আশ্চর্যে আমরা মুগ্ধ হই। দূরে দেখতে পাই ঝরনার জল নামতে নামতে কখন যেন পেনসিলে আঁকা হয়ে গেল। সারারাত ডাকবাক্সে ঘুমানোর পর রবিবার মাঠে নেমে এক্কাদোক্কা খেলে বৃষ্টির সাথে। মন এসব দেখতে পায় বর্ণপুঞ্জের সমাহারে রঙিন হয়ে ওঠা অনুভবের দুনিয়ায়। বাতচিত বা কথনের পরতে পরতে বিভিন্ন ভাঁজে থাকে ক্ষমতা-জ্ঞানের বিভিন্ন স্বর। সামনে উপস্থিত হয় ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব ইত্যাদি।

মূল কবিতায় কবির যে স্বর এবং যিনি পড়ছেন বা পুনর্নির্মাণ করছেন তাঁদের জ্ঞান বা অনুভবের জগৎ সহাবস্থানে আস্থা রাখে। যদিও সেখানে বিভিন্ন রকম আগল থাকে, প্রবেশের আলাদা আলাদা দরজা থাকে। দুটি লাইনের মধ্যবর্তী ফাঁকের মতো কবি ও পাঠকের মাঝখানে একটি দূরত্ব থেকে যায়। ঐ ফাঁকে বোঝাপড়া থাকতে পারে, নীরবতা থাকতে পারে, অসীম আকাশ থাকতে পারে, শূন্যতা থাকতে পারে এমনকি তৃতীয় কোনও অনুভব থাকতে পারে। মানে বুঝতে চাইলে অবশ্য দেখা যাবে, সব মানে মুছে গেছে। যেন তারা মুছে যাওয়ার প্রতীক্ষাতেই ছিল। আবার কেউ কেউ হয়তো দেখতে পাবেন তার মধ্যে ক খ গ ঘ ইত্যাদি সারা বিশ্বচরাচর ঢুকে আছে কিংবা স্থগিত রাখা হয়েছে মানেটাকে।

জগৎসংসার থেকে কবি শুধু ছেঁকে তুলে নেন নিজের অনুভবের আঙিনাটুকু, বিভিন্ন অণু পরমাণু ছানাবিন করে তাদের খুঁজে পেতে বার করে আনেন। সেখানে দেখা যায় প্রথম কবির অনুভব বা জ্ঞানের ছোট্ট টুকরো, যে কবি পুনরায় নির্মাণ করছেন তাঁর অনুভব বা জ্ঞানের মধ্যে ঢুকে পড়ে তার পুনরাবির্ভাব ঘটালো। সেরকম হলে প্রাথমিক কবিতার স্বাদ বর্ণ গন্ধ পুনরায় নির্মিত কবিতায় থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত নয়। পঠিত কবিতাগুলি মনের ভিতর অনুভবে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে এবং তখন মনে হয় এই পঠিত বয়ানের কোনো শেষ নেই, তা বিরামহীন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে রুণাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে তার নতুন টেক্সট। অবশ্য তা সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়ামুক্ত হতে পারে আবার নাও পারে। না হলেও কিছু এসে যায় না। যে পাঠক পড়বেন তাঁর ভালোলাগাকে বাজিয়ে তোলার অনুভবকে আমরা সর্বোচ্চ মূল্য দিতে প্রয়াস পাবো।

আমার স্বল্প জ্ঞান-বুদ্ধি অনুসারে, রুণার যাত্রাপথটি অনুধাবন করার এই চেষ্টা। তাকে সামান্য আলোকিত করে তোলার চেষ্টা। অনেক অন্ধকারও হয়তো থেকে গেল। টেক্সটগুলো পড়তে পড়তে আমায় মুগ্ধ করেছে অনুভবের মুক্ত ও স্বাধীন বিচরণ এবং অনুভবের সরে সরে আড়ালে যাওয়া। আড়াল সরিয়ে কখনো সে সামনে এসেছে আবারো পিছলে গেছে। পড়তে পড়তে আমার মনে বারবার একটা প্রশ্ন ভেসে উঠতে চেয়েছে, তা হল – প্রথম ও দ্বিতীয় পাঠের অন্তর্জাত অনুভবগুলি কি সবসময় বোঝাপড়া এবং সহাবস্থানে ছিল? নাকি সেখানে বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষের আবহাওয়াও তার ডানা মেলেছিল। যদি তারা সংঘর্ষে উপনীত হয়ে থাকে তাহলে একথা বলা যায় সবকটা জানলা দরজা হয়তো সম্পূর্ণভাবে নিজেকে খুলে মেলে ধরেনি। এছাড়াও তারা সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়ে থাকলে, সেখানে কার আধিপত্য বেশি ছিল, প্রথম না দ্বিতীয় টেক্সটির? এ প্রশ্ন থেকেই গেল।

এ নিয়েও কৌতুহল জাগে, যে তাঁর জার্নিতে আকাশ ভূমি পরিমণ্ডল কেমন ছিল! বিশেষত অবিনির্মাণ থেকে নির্মাণে পৌঁছনোর সময়। হয়তো চোখের মণির পিছনে যে শিশু লুকিয়েছিল সে হেসে উঠেছিল বাইরে এসে। ভালোবাসা তখন পৃথিবীর সমস্ত ভাষাতেই কথা বলছিল। গানের ওপর উঠে আসা মরুভূমিতে কেউ একটু রং করে দিয়েছিল। ঘাসের মাথায় আলোর বলগুলির পাশাপাশি ছুটে যাচ্ছিল নতুন বছর। কৃশ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে নিজের মুখ দেখছিল সম্মোহিত তামস। কিন্তু এ সবই তো আমার ভাবনায়। রুণার কথা বলা সম্ভব একমাত্র রুণার পক্ষে। পড়তে পড়তে বারবার মুগ্ধ হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি তার অন্যতর অবস্থান দেখে। এই পুনর্নির্মাণ সার্থক হোক। অবশ্য আমার কথায় আর কিই বা এসে যায়। এবার পাঠক, আপনারা……

তামসের আলোকভ্রমণ  সম্পর্কে বলছেন কবি উমাপদ কর

পাঠক-কবি রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। কবি-গদ্যকার রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। মিলেমিশে একাকার হলে কী হতে পারে তার সন্দর্ভ, এই গ্রন্থ তারই ফলিত রূপ। বাস্তবে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই এক বিপরীত ও সম প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কাব্যগ্রন্থের পাঠ-ক্রিয়া মননে বিপরীত ও সম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে তা বাস্তবোচিত নয়। সেখানে উড়ান, কখনও সমমেলে বেজে ওঠা, কখনও ভিন্ন পরিসর খুঁজে আনন্দভ্রমণ। বোবা-কালা-অন্ধ সময়ে যাপনের প্রেক্ষিতে কবিতা-পাঠে লহমায় জেগে ওঠা স্পন্দন দুলুনি ঝড় নাদে শব্দে ধ্বনিতে, রঙে আহ্লাদে বিষাদে মজায়, মেধার দীপ্তিতে ভরে তোলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শাদা পাতা। আর আমরা পেয়ে যাই ‘তামসের আলোকভ্রমণ’। কোনও আলোচনা সমালোচনা নয়, নিজস্ব নতুন তরিকায়, ভিন্ন চেতনায় গড়া অন্য স্বাদের এক অনন্য অসাধারণ কাজ, যা গমনে পাঠক আলোকিত হবেন।

Back To Home